সোশ্যাল মিডিয়াতেই মোটামুটি অনেকের লেখার সাথে পরিচয়। কয়েকজনের লেখার ধরন আমার বেশ পছন্দ তাই প্রথমেই খুঁজে পড়লাম অরুন্ধতী সাঁতরার লেখা, ‘ ওরা থাকে ওপারে’।
এস এস এর শক্তিশালী লেখিকা। দুনিয়া দেখা চোখের সাথে ক্ষুরধার কলম যোগ হলে কী আর হতে পারে? অরুন্ধতী সচরাচর হতাশ করে না। এখানেও করেনি। বিষয় বলুন, ভাবনাচিন্তা বলুন, ভাষা বলুন আমার মতে এই সঙ্কলনের অন্যতম সেরা গল্প।! গল্পে আছে যোনি দিয়ে বেরিয়ে আসা কিলবিলে নাড়িভুঁড়ি সত্যবৌ এর কথা, পেটে অজন্মা কাঠশিশু সমেত ঘুরে বেড়ানি ছিদামের বৌয়ের কথা্, ফিরিঙ্গি খেদানো পেটফুটো বীণার কথা, কেবলই দাঁড়িয়ে থাকা শিখার কথা, আরো আরো কত শত মেয়েদের কথা, যাদের কথা কেউ লেখে না। বড় স্পষ্ট , বড় কঠিন। আসলে এ তো ঠিক গল্প নয়। হেরে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া মানুষের জিতে যাওয়ার কথা। সেই কবে আর্তি জানিয়েছিল সাধারণ মেয়েটা, আজকের দিনে কোনো একজন সেই কাজটা করল।
এমন একটা পজিটিভ গল্প লেখার জন্য অভিনন্দন অরুন্ধতীর কলম সচল থাকুক, আরও অনেক অনেক লেখা আসুক এই কামনা করি।
নয়ন বসুর লেখার সাথে এই প্রথম আলাপ। ‘ আসা যাওয়ার পথের ধারে’ পঁয়ষট্টি বছরের শৈলেনবাবু, ওঁর পুত্র টাবলু, টাবলুর লক্ষ্মীমন্ত স্ত্রী সোহিনী আর তাদের পুত্র আরিয়ানের ভাব ভালোবাসার 'ভালো-বাসায়' ইহজগতের থেকে চলে যাওয়া স্ত্রী কামিনীদেবী, দাদু কিঙ্কর, মা সরলাদেবীর হঠাৎ হঠাৎ দেখতে আসার মিষ্টি গল্প। তেমন তত্ত্বকথা নেই, আটঘাট বেঁধে ভয় দেখানোর চেষ্টা নেই। বেশ একটা ঝরঝরে, মিষ্টি, মন ভালো করা মুখে হাসি আনা লেখা।
দ্বিজরাজ স্যানালের লেখা ‘আঙ্গাককের দেশে’এস্কিমোদের নিয়ে লেখা ভারী চমৎকার ছোটগল্প। লেখক কোথায় থাকেন জানি না, তবে স্বচক্ষে না দেখে এমন নিখুঁত বর্ণনা ভাবতে পারছি না। আর্কটিক অঞ্চলের কথা বাংলায় এমন গল্পচ্ছলে এই প্রথম পড়লাম (স্বীকার করতে লজ্জা নেই আমার পড়ার পরিধি তেমন বিস্তৃত নয়)। গল্প পড়ে ইনুইতদের ভাষা, তাদের কঠিন অথচ সরল জীবনযাত্রা আমাকে মুগ্ধ করেছে। ওরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত শিকার করে না, হাজার কষ্টেও ওদের মুখের হাসি থাকে অমলিন। যুদ্ধ শব্দটাই তাদের জানা নেই, তাই গ্রীনল্যান্ডে নিজস্ব মিলিটারি নেই। বরং সভ্যতার সংস্পর্শে এসে তাদের মধ্যে অনেক বিকৃতি চলে আসছে। আসলে প্রকৃতির কোলে যাদের বসবাস, তাদের চিন্তাধারা সর্বত্র এমনটাই। তাই আমাদের কোল, মুন্ডা, ভীল, শবরেরা আর্কটিক প্রদেশের ইনুইতদের সাথে এক হয়ে যায়। মানুষ ও মনুষ্যত্ব নিয়ে লেখাটি বার বার পড়লাম। খুব ভাল লেগেছে। ( আমার সবচাইতে মজা লেগেছে ইগলুর মধ্যে ফ্রিজ রাখর উল্লেখে!)
ফয়েজ আহমেদ এর গল্প ‘ কষ্ট যদি দাও প্রভু’ আমাকে অবাক করেছে। ফয়েজের গল্পের পটভূমি মরিশাস। লেখকের রসবোধ, গল্পের বুনন ভারী চমৎকার। ইমিগ্রান্ট বাংলাদেশি লতায় পাতায় জড়ানো বৃহৎ পরিবারে এসে যুক্ত হওয়া নতুন ভারতীয় জামাতার কথা। সুখ দুঃখ মিলিয়ে প্রতিটি ঘটনা মিষ্টি হাস্যরসে চুবিয়ে পরিবেশন করাটা কঠিন কাজ। লেখকের প্রেডিক্টেবল গল্প। আপনি বুঝবেন গল্প কোন পথে এগোচ্ছে, লেখক নিজেও সেটা জানেন। তবু পড়তে ভালো লাগে, কারণ উনি গল্প বলতে জানেন।
অনন্যা বসু নিজের ডাক্তারির অভিজ্ঞতার সাথে কল্প বিজ্ঞানের মিশেল দিয়ে চমৎকার গল্প লিখেছেন।অভাবে স্বভাব নষ্ট? তাবলে এমন হয়? শীর্ষা গাঙ্গুলির লেখা ‘মুখোশ মানুষ’ এ মাকড়সার জালের মতন অভাব বীথিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলছে। বীথি মহামায়া আয়া সেন্টারের মারফৎ কাজ পায়। বাড়ি বাড়ি কাজ করতে করতেই বীথি নার্সিংয়ের কাজটা শিখে ফেলে। নানা বাড়ির নানান রকমের গল্প, কেচ্ছা... এর সাথে বীথির জীবনের সমস্যা। কিভাবে তার সমাধান হল, এটাই গল্প। শীর্ষার লেখার গুণে পরিবেশ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ঘটনার অসহায়তা অনুভব করি।
চয়ন সমাদ্দার আমার পছন্দের লেখক, পছন্দের মানুষও বটে। তাই ভাল জিনিষটা সব শেষে তারিয়ে তারিয়ে খাব বলে রেখে দিয়েছিলাম। তাঁর গল্পের নাম ‘চরিত্রহীন’। আত্মকথার মতন করে লেখা চয়নের এমন ধরণের রচনা আগে পড়িনি। সদ্বংশজাত, বিদ্বান নায়ক বিচ্ছেদের পর মামাবাড়ি মায়ের পরামর্শে পলাশপুরে এসে হাজির হয়। বিচ্ছেদের পর সমাজের প্রতিক্রিয়ায় নায়ক তখন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। মিথ্যে অপবাদ তাকে কুরে কুরে খায়। এমন অবস্থায় সোমদত্তা নামে এক তরুণীর সাথে পরিচয়। তারপর কী হল তা সহজে অনুমেয় হলেও অঙ্কটা ঠিক অতটা সহজ করে মেলানো যায় না। ভালবাসার মধুর রঙে রাঙানো লেখা পড়ে ফিলগুড অনুভূতি হল। আজকের কাঠখোট্টা জগতে প্রেম আছে দেখে ভাল লাগল। পঞ্চাশোর্ধ্ব নায়কের প্রতি তরুণী নায়িকার বলিষ্ঠ প্রেম নিবেদন এতটুকু খারাপ লাগল না। বরং মনে হল এটাই স্বাভাবিক, এটাই সহজ, এমনটাই ঠিক। সহজকে সহজভাবে না বুঝতে পারা সমাজের গালে সপাটে মারা চড়। খুব ভাল লাগল। তবে আমার মনে হল এই বিষয় নিয়ে স্বচ্ছন্দে উপন্যাস লেখা যেত। লিখলেই পারেন। মানসিক সমস্যার কথা, যার একটু আভাস মাত্র দিয়ে ছেড়ে দিলেন, সে বিষয় নিয়ে লেখার অনুরোধ রইল। আপনার সোনার কলম দীর্ঘজীবী হোক। কাহিনীর বুলুর মতন আমিও চাই আপনি একদিন সাহিত্য একাডেমী পান।
বইয়ের শেষ গল্পের সাথেই আমার রিভিউ শেষ করব, হৈমন্তী ভট্টাচার্যের লেখা ‘স্বপ্নোত্থিতা’ দিয়ে। হঠাৎ গজানো ইংরেজি স্কুলে পড়তে গিয়ে কাত্যায়নী হয়ে গেল কাটিয়ানী। তারপর সেই ‘কাটিয়ানী’ ইংরেজির মোহ ঘুচিয়ে ভর্তি হল বাংলা অনার্সে। বাংলা অনার্স আর কে পড়ে? যত ফেল করা ছেলে মেয়ে ছাড়া? সেই ক্লাসেই কাটিয়ানীর দেখা হল স্বর্ণেন্দুর সাথে। কাটিয়ানী ফিরে এল কাত্যায়নী হয়ে। তারপর যা হল তা এককথায় ম্যাজিক! দমবন্ধ করে ছুটতে থাকা সাধারণেরা যখন জিতে যায়, অসাধারণ হয়ে ওঠে, তাদের স্বপ্নপূরণ হয়, তখন আমার খুব ভাল লাগে। আমরা সবাই আসলে হেরোদের জিতে যাওয়া দেখতে চাই। আহা বড় ভালো লিখেছেন হৈমন্তী!
মন ভরানো এই ধরনের চমৎকার লেখা দিয়ে ‘চব্বিশ ক্যারাটশেষ। সত্যি বলতে তেইশটি গল্পই খুব ভালো। বলতে ইচ্ছে করে শ্রাবণী দাশগুপ্তের লেখা আলো পুচ্ছর কথা , সুষমা ব্যানার্জীর প্রতীক্ষা, অরুণাচল দত্ত চৌধুরী দেওয়াল। ভীষণ ভীষণ ভালো লেগেছে বাপ্পাদিত্য দাসের 'তুই আমায় পাগল করলি রে'।